আত্মহত্যা বা সুইসাইডের ঘটনা যতটা ভাইরাল হয় কিংবা শেয়ার হয়, আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক কোন লেখা বা ভিডিও তার অর্ধেকও হয় না! কারণ কি?

কারণ আত্মহত্যার ঘটনায় মসলার সন্ধান পাওয়া যায়, যেইটা নিয়ে গা গরম করা গল্প করা যায়। যেমন, কোন আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তার প্রোফাইল ঘুরে আসলে হয়ত বুঝতে পারবেন সবাই একটি মেয়েকে কেন্দ্র করে পুরো বিষয়টি নিয়ে চটকদার আলোচনা করছে এবং সেটাই মূল ইস্যু করে তুলছে। অথচ আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত ছিল আর কি কি করা যেত এবং ভবিষ্যতে করবে সেগুলো।

মসলার কথা যখন বলছিলাম, বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো প্রায় ২৭-২৮ টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে যা প্রতিদিন ঘটছে, কোন কোন হিসাবমতে সেটা ৬০+, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কেউ নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। আর আত্মহত্যার চেষ্টা করছে তার থেকেও ২০-২৫ গুন বেশি মানুষ; অথচ সেগুলোতে মসলা নেই বলে আমাদের আগ্রহ নেই। ঘটনায় তার প্রোফাইলে গেলেই বুঝা যাবে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া এবং আচরণের কিছু নমুনা।

একজন ছেলে আত্মহত্যা করেছে, তার প্রোফাইল ঘুরে আসলে বুঝা যাবে সে একটি সম্পর্কের টানাপড়েন ও বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, পুরো সময়টি জুড়ে তার বন্ধু তালিকায় থাকা মানুষের মন্তব্য এবং আত্মহত্যা করার পর তার স্ট্যাটাসে অগণিত মানুষের মন্তব্যগুলো যদি খেয়াল করেন তবে কিছু আচরণ উঠে আসবে যেগুলো সামগ্রিক ভাবে একজন ব্যক্তির আত্মহত্যা করার প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে সমাজে। দেখে নেই সেই পয়েন্ট গুলোঃ

১। বিচার (জাজ) করার প্রবণতাঃ একজন ব্যক্তি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হলে তার সব থেকে বেশি প্রয়োজন Unconditional Acceptance & Nonjudgmental Attitude; অথচ আমরা ক্রমাগত বিচার করে যাচ্ছি তাকে। সে কাপুরুষ, সে এত ছোট্ট ঘটনার জন্য কেন ডিপ্রেসড; সে কেন বাবা মা পরিবার বা অন্যদের কথা ভাবে না, স্বার্থপরের মত কেন সে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাই, একটু থামেন। আপনি জানেন না তার কেমন কষ্ট হচ্ছে; নিজের উপর না আসা পর্যন্ত অন্যকে বিচার করতে ভালোই মজা পাচ্ছেন কিন্তু তার কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছেন না। আর মিডিয়া ট্রায়ালে মেয়েটা অলরেডি দোষী সাব্যস্ত এবং চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া হয়ে গেছে; কি আজব!

২। উপদেশ ও সমাধান দেয়ার প্রবণতাঃ কোন মানুষের যেকোন সমস্যা শুনলে আমাদের মধ্যে একটা সহজাত প্রবণতা কাজ করে সেটা হলো সমাধান বের করা, এইটা খুবই ভালো একটা গুণ। কিন্তু মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত একজন ব্যক্তির জন্য সমাধানের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সাপোর্ট; অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই জানে তার সমাধান কি, আপনাকে প্রয়োজন তাকে পাশে। কিন্তু আপনি নিজের শিক্ষা, ধর্মীয় নৈতিকতা আর অভিজ্ঞতার মিশেলে এক অদ্ভুত সমাধানের পথ বাতলে দেন যেইটা তার ক্ষেত্রে খাটে না। নামাজ পড়, বাবা মায়ের কথা চিন্তা করো, ঘুরে আসো কোথাও, এইটা করো সেটা করো ইত্যাদি ইত্যাদি!! ভাই, এই জিনিস গুলো উনি জানেন, এমনকি উনি আরো ভালোভাবে হয়ত চেষ্টাও করেছেন কিন্তু পারছেন না, যার ফলে উনার কষ্ট টা আরো বেড়ে যাচ্ছে; কেননা এত চেষ্টা করেও উনার মানসিক কষ্ট টা কমছে না, এতই প্রবল হচ্ছে যে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। আপনার কিংবা আমার অভিজ্ঞতালব্ধ সাজেশন সে ক্ষেত্রে কাজ নাও করতে পারে, এখন তাতে আমাদের কি করার আছে? আমরা নিজেদের সাজেশন বা সমাধান প্রথমেই চাপিয়ে দিবো না, আগে তার অবস্থা শুনব এবং বুঝার চেষ্টা করব পাশে থাকার জন্য।

৩। গোপনীয়তা না রাখা এবং মজা নেওয়াঃ কারো কষ্টের কিছু গোপন রাখতে হবে এই ধারনাটা যেন আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ। কেউ কোন ছোট কিংবা বড় কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেলে আমাদের প্রথম কাজ বাকিদের জানানো এবং সেটা নিয়ে মজা করা, তীর্যক বিদ্রূপ করা যেন নিয়মিত ঘটনা। আত্মহত্যার ঘটনা অনেকের জন্যেই হয়ে উঠছে মজা করার উপাদান। তার স্ট্যাটাস শেয়ারকারি অনেকের ক্যাপশন এবং মন্তব্যগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন। ভাগ্য ভালো সে বেচে নেই; থাকলে আরেকবার আত্মহত্যা করত এইসব দেখে। মানুষের এই মন্তব্যগুলো পরোক্ষ ভাবে তার আশপাশের মানুষকে প্রভাবিত করছে, এটা যদি বুঝতে না পারেন তাহলে খুবই কঠিন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।

৪। সহমর্মিতার অভাবঃ আমরা খুব সহজেই অন্যের প্রতি করুণা বা সমবেদনা প্রদর্শন করতে পারি কিন্তু তার জায়গায় গিয়ে বুঝার চেষ্টা করি না তার কেমন লাগছে। আমি সেখানে থাকলে আমার কেমন লাগত। ন্যুনতম সহমর্মিতার চর্চা থাকলে একজন মানুষ আরেকজন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের অনুভূতি গুলো বুঝতে পারতাম।

৫। কথা শুনতে অনাগ্রহঃ কথা শুনতে পারা টা একটা দক্ষতার বিষয়, বিশেষ করে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি গুলো শোনার জন্য জানতে হয় কিভাবে কথা শুনতে হয়। অনেকের মাঝে হয়ত প্রকৃতিদত্ত কিছু গুণ থাকে কথা শুনার তবুও সেটা আরো ঝালাই করে নিতে হয় যখন কোন মানুষকে মানসিক সহায়তা দিতে যাবো। সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার ঘটনার পরে আমি একটি লেখা শেয়ার দিয়েছিলাম কিভাবে মানুষের কথা শুনতে হয়; এখনো একই কথা প্রযোজ্য; মানুষের কথা শুনার দক্ষতা অর্জন করুন। খুব কঠিন কিছু না, একটু চেষ্টা করলেই পারবেন।

৬। সঠিক সাহায্য করতে না পারাঃ অনেক সময় দেখা যায় আসলে তার বন্ধুরা আগের দিনও তার সাথে ছিল, সময় দিয়েছে এবং অনেক চেষ্টা করেছে তাকে সাহায্য করার এবং পাশে থাকার। আমি সত্যি সাধুবাদ জানাই সেই বন্ধুদের কে! একটা বিষয় লক্ষণীয় আমরা সবাই চাই আমাদের কাছের মানুষটি বেচে থাকুক কিন্তু জানি না তাকে কোন ধরণের সাহায্য দিবো। আপনি কিডনির পেশেন্ট কে হার্টের ডাক্তার রেফার করেন না, তেমনি যখন দেখতে পাচ্ছে কোন কিছুতেই ব্যক্তি আত্মহত্যার চিন্তা থেকে বের হতে পারছে এবং ভীষণ বিষণ্ণ, তখন তাকে মানসিক ডাক্তার বা মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে যেতে হবে, এই বিষয়টা আমরা কেউই খেয়াল করলাম না!

উপরের কাজ গুলো নিয়মিত ভাবে কম বেশি আমরা সবাই করি, এবং নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি, যা আদতে আপনার কাছের কারো জন্যেই ক্ষতিকর হচ্ছে। হয়ত আরেকজন মানুষ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করছে, কিন্তু আপনি পাশে থেকেও নেই!!!

তাহলে করনীয় কি?!

উপরের কাজ গুলো করবেন না, বরং উলটো টা করুন, কোন প্রকার জাজ না করে মনোযোগ দিয়ে শ্রদ্ধাপূর্ণ পরিবেশে কথা শুনুন। তার আবেগ অনুভূতি আর আচরণ কে গুরুত্ব দিন এবং পাশে থাকুন, তার যেকোন অভিজ্ঞতা কে মেনে নিতে শিখুন এবং সঠিক সাহায্য গুলো তার কাছে পৌঁছে দিন। সঠিক সাহায্য হলো জরুরি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারে এমন হেল্প লাইন, সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিক্যাল প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার গুলো আপনার মোবাইলেই রাখুন যাতে প্রয়োজনে দিতে পারেন।

একটা কুইজঃ আমার বন্ধু তালিকায় থাকা কার কার মোবাইলে হেল্প লাইন বা সাইকোলজিস্ট বা সাইকীয়াট্রিস্ট বা কোন প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকানা আছে যেটা চাইলেই আপনি কাউকে দিতে পারেন?

আমি আপনার কাছে চাইছি, আমাকে কি দিতে পারেন? পারলে কমেন্ট করে রেখে যান, আমি সহ যাদের দরকার তাঁরাও জেনে পেয়ে যায়।