মৃত্যু চিন্তা : ও আত্মকথন



By:


January 29, 2024


Share This Post

Categories:

Development


ইদানিং আমার মৃত্যু চিন্তা আসে। মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক একটি পরিণতি কিন্তু ভয়ংকর একটি অনুভূতি। ছোটবেলা থেকে আমার নিজের একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে আমি সহজে মরবো না, অন্তত রোগ শোকে তো না ই, এমন কি হুট করেও না। তবে কিছুদিন হলো সে ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। এখন মনে হয় যেকোন একটা বডি অর্গান অকার্যকর হলেই তো মৃত্যু। আর আমাদের শরীরে এমন গুরুত্বপূর্ণ অর্গান আছে বেশ কিছু যেমন মস্তিষ্ক, হৃদপিন্ড, লাং, কিডনি, লিভার ইত্যাদি, তাছাড়া যেকোন প্রকার রোগ ও ক্যান্সার তো আছেই মৃত্যু ঘটানোর জন্য। পুরো বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া এবং আমার মেনে নিতে বিন্দু মাত্র কষ্ট হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে মৃত্যু অন্যান্য দৈনন্দিন ঘটনার মতই একটি, তবে এর কিছু প্রভাব হয়তো আমাদের চারপাশে দেখা যায় সাময়িক ভাবে কিন্তু ধীরে ধীরে সেটাও কেটে যাবে। তাই মৃত্যু নিয়ে আরেকটু ভাবার চেষ্টা করলাম, মৃত্যুর ডেফিনিশন কি সে আলোচনায় গেলাম না কারণ সেটা বিশাল, আমার আগ্রহ আসলে বিভিন্ন সময়ে মানুষ মৃত্যু বিষয়টা কে কিভাবে দেখে সেটা বোঝা?

ফ্রয়েডের টোটেম ও ট্যাবু বইতে আদিকালের মানুষদের মৃত্যু সংক্রান্ত নানা ভাবনা কিছুটা হলেও আলোচনা করা হয়েছে, যখন মানুষের মাঝে পুরোপুরি সভ্যতা বা কাঠামোবদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস তৈরি হয় নি তখন মানুষ আসলে মৃত্যু নিয়ে কি ভাবত? একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর বিশ্বাস ছিল মানুষ আসলে মারা গেলে সে আত্মা হয়ে পৃথিবীতেই থাকে এবং পুনরায় কোন নারীর গর্ভে জন্ম লাভ করে। অর্থাৎ মানব জীবন একটি লুপে র মধ্যে চলছে, একবার মারা যাওয়ার পরে তার আত্মা আশপাশেই অবস্থান করে দ্যান নিজস্ব সময় অনুযায়ী হয়ত আবার ব্যাক করে।
আরেকটা ইন্টারেস্টিং আলোচনা দেখতে পাই মৃত্যুর পরের জীবনের কনসেপ্ট নিয়ে। আধুনিক যুগে বা ধর্মগুলোর প্রসারের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মৃত্যু পরের জীবন এবং সে জীবনের সাথে ইহকালের সম্পর্ক ও তাৎপর্য নিয়ে। ফ্রয়েডের আলোচনায় দেখতে পাই যে ইহকাল ও পরকালের কনসেপ্ট বিবর্তিত হয়েছে এপার এবং ওপারের ধারণার উপর নির্ভর করে। প্রাচীন যুগে আদিবাসী গণ মৃতদের সৎকার করার জন্য নানা রকম পদ্ধতি অবলম্বন করতে, আত্মাদের উৎপাতের ভয়ে কেউ জঙ্গলে রেখে আসত, কেউ পুতে ফেলত, কেউ নদীতে ভাসিয়ে দিত। এর মধ্যে বেশ কিছু গোষ্ঠী মৃতদের নদী পার করে একটি আলাদা ভূখণ্ডে কবর দিতো বা পুড়িয়ে ফেলত অথবা জঙ্গলে রেখে আসত এবং সেখানে যাওয়া নিষেধ ছিল সর্বসাধারণের জন্য। সকলের মাঝে এই ধারণা ছিল যে ওপারে একবার গেলে কেউ ফিরে আসে না, ওপারের জীবন রহস্যময়। ওপার এপার এর কনসেপ্ট ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধর্মগুলো বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রচার করতো এবং সাথে যোগ করতো বিভিন্ন মিথ, সেখান থেকেই আধুনিক ধর্ম গুলো এত চমৎকার গোছানো ব্যাখ্যা দিতে পারে পরকাল সম্পর্কে। এখন আমরা সে ব্যাখ্যাগুলো মেনে নিচ্ছি এবং সেগুলো বিশ্বাস করে নিজেদের স্পিরিচুয়াল প্র্যাকটিস অব্যাহত রাখছি।

তো মৃত্যু সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আদিম যুগ থেকে তুলনামূলক একটু সভ্য যুগের আলোচনা করা দরকার। আমরা যদি খেয়াল করি আদিম যুগ থেকে মধ্যযুগ এমনকি আধুনিক যুগের প্রথম ভাগে মৃত্যু কে খুব স্বাভাবিক একটি পরিণতি ধরা হচ্ছিলো (অন্যতম একটি কারণ ছিল মানুষ তখন অহরহ মারা যেত বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে যুদ্ধ কিংবা মহামারীর জন্য), এমন কি মৃত্যুকে পরবর্তী অন্তিম জীবনের সূচনা হিসেবে ভাবা হতো ফলে বেশ প্রস্তুতি নেওয়ার মানসিকতা ছিলো। অস্বাভাবিক মৃত্যু বাদ দিলে মানুষ তাদের মৃত্যু কে খুব স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করেছিল, তাই মৃত্যু কেন্দ্রিক নানা রকম ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক প্রথা চালু হয়েছিল যা বেশ ভাব গাম্ভীর্যের পালন করা হতো, এখনো হয় তবে এখন মৃত্যু কে মেনে নিতে মানুষের অনেক কষ্ট হয়। কেন হয় সে ব্যাখ্যা দিয়েছেন নেজাম উদ্দীন আহমেদ স্যার, উনি হলেন পিজি হাসপাতালের প্যালিলিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। বর্তমানে অবসপ্রাপ্ত এই অধ্যাপকের সাথে এক আড্ডায় উনি বলেছিলেন, দেখো এখন মানুষ মৃত্যু কে ভয় পায় কারণ সে মনে করেছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে সে বেচেঁ যাবে। আধুনিক যুগে যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান ব্যাপক উন্নতি করলো তখন সে মৃত্যু কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো, ফলাফল হলো যখন মৃত্যু আসে তখন সে মেনে নিতে পারে না। তাই হাজার টা ডাক্তার দেখানো, দেশ বিদেশে চিকৎসার জন্য ছোটাছুটি করে শুধু একটু বেচেঁ থাকার জন্য, অথচ সে যদি বুঝত এবং মেনে নিতো যে এইটা অবধারিত তাহলে মৃত্যুকালীন তার কষ্ট টা কম হতো। সে আরো শান্তিতে বিদায় নিতে পারতো। আদিকালে এমনকি মধুযুগেও যেকোন মৃত্যুর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হতো। ফারাওদের মমি দেখলে আমরা দেখতে পাই সেখানে কত ব্যাপক আকারে আয়োজন করে মৃত্যু কে গ্রহণ করা হতো। এর থেকে বোঝা যায় সাধারণ মানুষদের মাঝেও সেটার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কিন্তু এখন সেটা একেবারে নাই বললেই চলে, এর ফলে মৃত্যুকালীন কষ্ট বেড়েই চলছে বিশেষ করে মানসিক কষ্ট।

এই মানসিক কষ্ট নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। মৃত্যু চিন্তা থাকা ভালো যেমন আমাদের ইসলাম ধর্মে আছে মৃত্যু ভয় থাকলে আমরা অনেক পাপ কাজ থেকে দূরে থাকব, তেমনি আমরা নিজেদের মোটিভেট করতে পারি ভালো কিছু চর্চা করতে। কিন্তু যারা মৃত্যু কে প্রচণ্ড ভয় পায়, যাদের মৃত্যু কেন্দ্রিক চিন্তা স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধা সৃষ্টি করে তাদের জন্য আসলে কষ্ট টা বেশি। তারা মেনে নিতে পারে না যে জীবন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমাপ্তি ঘোষণা করতে পারে। এর ফলে যে দুশ্চিন্তা, অসহায়ত্ব, কষ্ট হয় সেটা আসলে যে না যায় এর মধ্য দিয়ে সে বুঝবে না। জীবনের প্রতিটা ফেজ স্বাভাবিক ভাবে যদি এগিয়ে যায় তবে এর পরিণতি হিসেবে সমাপ্তি আসবে সেটাই স্বাভাবিক, এবং সেটা মেনে নিয়ে প্রস্থান করলে মৃত্যুকালীন কষ্ট যেমন কম হয় তেমনি মৃত্যুর পূর্ববতী জীবন আরো সহজ হয়। অবশ্য অস্বাভাবিক মৃত্যু (দুর্ঘটনা, খুন, গুম) এর শিকার হওয়া ভিন্ন এক মানসিক অভিজ্ঞতার জন্ম দিতে পারে।

এই মুহূর্তে আমার মৃত্যু কেন্দ্রিক চিন্তায় আরো অনেক অনেক সাইকোলজিক্যাল তত্ব, দর্শনের ব্যাখ্যা, জৈবিক ধারণা ইত্যাদি আসছে কিন্তু এত কিছু লেখায় উঠিয়ে আনার মত দক্ষ লেখক আমি নই। তবে চেষ্টা করব ভবিষ্যতে কিছু আলোচনা করার। শুধু একটা জিনিস আমি মনে করি সেটা হলো মৃত্যু কে গ্লোরিফাই করার যেমন কিছু নাই, তেমনি পাত্তা না দেওয়ার কিছু নাই, শুধু মেনে নিলেই হলো। যখনি আসুক আপনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকুন, তাহলে আর কষ্ট হবে না। প্রিয়জনের মৃত্যু কিংবা নিজের মৃত্যু চিন্তা আমাদের কষ্ট দিবে, এইটাই স্বাভাবিক। এই কষ্ট ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠা সম্ভব, যাদের পক্ষে কাটিয়ে উঠা কঠিন মনে হচ্ছে তারা অবশ্যই প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট দের সাহায্য নিবেন, এতে আপনি যেমন প্রোডাক্টিভ এবং হেলদি থাকবেন তেমনি আপনার চারপাশের মানুষজন ভালো থাকবে।

প্রতিটা মানুষ একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে স্বাভাবিক মৃত্যু প্রত্যাশা করে এবং এইটা তার অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্যেই সে গোষ্ঠী, সমাজ ও পরে রাষ্ট্র গঠন করেছে। তাই রাষ্ট্রের কোন নাগরিক যখন গুম হয় বা হত্যার হুমকি পায় হোক সে যেকোন ব্যাকগ্রাউন্ডের তখন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য ফরয।
*(সম্প্রতি নায়িকা পরীমনি কে ধর্ষণ চেষ্টা ও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং মাওলানা আদনান চারদিন ধরে নিখোঁজ, দুজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কোন ভাবেই এমন মৃত্যু র হুমকি বা গুমের আশঙ্কা করতে পারে না। আশা করি রাষ্ট্র সঠিক ব্যবস্থা নিবে যদিও পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছি না বলে দুঃখিত)

সর্বশেষ আমার প্রিয় সিরিজ গেম অফ থ্রনস এর একটি ডায়লগ দিয়ে শেষ করতে চাই যেটি আসলে মৃত্যু কে একই সাথে মেনে নেওয়া ও মেনে না নিতে পারার দোদুল্যমান মানসিকতার দিকে ইঙ্গিত করে।

“Death is the enemy and enemy has always been win, what we can do is fight, till the end”

যেকেউ চাইলে মৃত্যু সংক্রান্ত নিজের চিন্তা ভাবনা শেয়ার করতে পারেন, আলোচনা চলতে পারে।

Latest Posts



Image
Memory & Mental Health
Image
By: Sarah Sultan
April 30, 2025
Image
“রাগ ব্যবস্থাপনার সহজ ও কার্যকর উপায়”
Image
By: Rakibul Hasan Sourav
April 30, 2025
Image
“নারীর মানসিক স্বাস্থ্য ও একটি সুস্থ প্রজন্ম গঠনে তার ভূমিকা”
Image
By: Rakibul Hasan Sourav
April 30, 2025
Image
DO YOU LOVE YOUR CHILD? Does your child feel loved?
Image
By: Sarah Sultan
April 30, 2025